গ্রিক স্টাইলাস টু ওয়াকম গ্রাফিক্স ট্যাবলেট

কালো কলম দিয়ে লাল লিখতে পারবে ? স্কুল জীবনে বন্ধুর থেকে এই প্রশ্ন শোনেননি এমন মানুষ কম। প্রশ্নটি অনেক শিক্ষার্থীর কাছে জটিল ঠেকত। যারা চতুর ছিল, তারা কলমটি নিয়া খাতার উপর লিখত- ‘ল-এ আ-কার ল’। ব্যস, হয়ে গেল কালো কলম দিয়ে লাল লেখা। বাবা-দাদারা যেই কলম ব্যবহার করতেন, তা থেকে নাকি কালি ঝরে পকেটের দফারফা হয়ে যেত। তার আগে নাকি ছিল বাঁশের কঞ্চি কেটে কলম বানানোর চল। রাজ-রাজরাদের কাহিনী নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রে পাখির পালকের কলম দেখা যায়। পশুর হাড়ের কলম, বাঁশের কলম, পালকের কলম, দোয়াত কলম, ফাউন্টেনপেন, বলপেন, জেলপেন- সবকিছু শেষে এখন চলছে বৈদ্যুতিক কলমের যুগ। সেটির নাম স্টাইলাস। মজার বিষয় হচ্ছে, কলমের সর্বপ্রথম নামও ছিল স্টাইলাস। সেটি প্রাণীর হাড় কিংবা দাঁত দিয়ে তৈরি করত গ্রীকরা। বিশেষ করে হাতীর দাঁত। সেটি দিয়ে তৈরি কলমকেই স্টাইলাস ডাকা হতো। হাতীর দাঁতের স্টাইলাস টু বৈদ্যুতিক স্টাইলাস- কলমের এই যাত্রায় পেরিয়ে গেছে পাঁচ হাজার বছর।

 

হাতির দাঁতের স্টাইলাস

কলমের ব্যবহার সর্বপ্রথম চালু হয় মিসরে। সেটা পাঁচ হাজার বছর আগে। তারপর পঞ্চম শতকে পাখির পালক ব্যবহার হতে থাকে কলম হিসেবে। বিশেষ করে রাজহাঁসের পালক। লেখার সুবিধার্তে পালকের মাথা সুচালো করে নেওয়া হতো। কিন্তু এসব কলম ব্যবহার করা হতো লিখিত বর্ণমালা আবিষ্কারের পর। অনেকেই বলে থাকেন ‘বর্ণ’ একপ্রকার ‘চিত্র’। তাদের এ কথার যৌক্তিকতাও আছে। যেমন মিসরীয় Heiroglyphics। একেকটি চিত্রই একেকটি বর্ণ হয়ে উঠেছে সেই লিপিতে। তাই চিত্রই বর্ণ, বর্ণই চিত্র। এই যুক্তিতে লেখালেখির তথা ছবি আঁকাআঁকির সূচনা মানুষের সেই গুহাবাসী দশা থেকেই। অন্ধকার গুহাগাত্রে আদিমমানুষেরা কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে ছবি আঁকত। তাই কাঠিই প্রথম কলম।

মধ্যযুগে কাগজ আবিষ্কারের পর পাখির পালকের সঙ্গে ব্রোঞ্জ যুক্ত করে একপ্রকার কলম তৈরি হতে থাকে। সেটির নামও রাখা হয় স্টাইলাস। জুলিয়াস সিজারও তা ব্যবহার করতেন বলে জানা গেছে। আধুনিক স্টাইলাসের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। ১৭৮০ সালে তা তৈরি হয় ইংল্যান্ডে। কিন্তু তখন সেটির নাম গেল বদলে। স্টাইলাস নয়; ফাউন্টেনপেন। বিংশ শতাব্দীতে এসে তৈরি হয় বলপেন। কিন্তু একই শতাব্দীতে আবারও ফিরে আসে স্টাইলাস। ১৯৬৩ সালে। একেবারে নতুন রূপে। প্রযুক্তি চমক নিয়ে। যান্ত্রিক স্টাইলাসে কালি নেই। বাইরে থেকে কালি ভরাও লাগে না। তার বদলে তাতে থাকে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ। ইলেকট্রিক স্পার্কের মাধ্যমে কাজ করে। সেটি দিয়ে লেখাও যায় আবার ছবিও আঁকা যায়। কিন্তু যে কোনো মাধ্যমে নয়। পাথর, কাদামাটি, ধাতু, পাতা, হাড় কিংবা কাগজে লেখা সম্ভব নয় আধুনিক স্টাইলাস দিয়ে। চাই বৈদ্যুতিক Slate। যার নাম গ্রাফিক্স ট্যাবলেট।

ব্রোঞ্জ স্টাইলাস

গ্রাফিক্স ট্যাবলেট এক ধরনের হার্ডওয়্যার ইনপুট ডিভাইজ। যতটা না লেখার কাজে ব্যবহার হয়, বর্তমানে তারচেয়েও বেশি হয় আঁকাআঁকির কাজে। ডিজিটাল আর্টিস্ট ও গ্রাফিক্স ডিজাইনারদের কাজকে সহজ ও স্মার্ট করেছে এই যন্ত্রটি। এতে শক্ত ও টাচ-সেন্সেটিভ সার্ফেস থাকে। সেই তলের উপর স্টাইলার ঘোরালে সেটির মুভমেন্টকে কম্পিউটার মনিটরে ট্রান্সফার করে। মনিটরে ইমেজ তৈরি হয়। ফলে লেখালেখি কিংবা আঁকাআঁকির সুবিধা হয়। তবে এই যন্ত্রটি হুট করে উদ্ভব হয়নি। এরও আছে ৭৭ বছরের বিবর্তনের ফিরিস্তি।

ইলেকট্রিক স্পার্কই হবে একটি স্টাইলাসের কালি। লেখা হবে বৈদ্যুতিক সংবেদনগ্রাহী একটি তলে। এমন একটি ট্যাবলেট বাজারে এনেছিল র‌্যান্ড কোম্পানি। জানা যায়, তখন তা দিয়ে কেবল লেখা যেত। ছবি আঁকার মতো জটিল কাজ করা যেত না। স্টাইলাস ভিত্তিক ইনপুট সর্বপ্রথম বাজারে আনে এই কোম্পানিটিই। তখন অবশ্য এটিকে গ্রাফিক্স ট্যাবলেট নয় বরং ‘গ্রাফকন’ নামে ডাকা হতো। গ্রাফিক্স কনভার্টার শব্দটির সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে গ্রাফকন। ১৯৬৪ সালে ডিভাইসটি যাত্রা শুরু করে। এর প্রায় ১৫ বছর পর হাল ধরে অ্যাপল। ১৯৭৯ সালে। এটি গ্রাফকমের চেয়ে উন্নত ছিল। জানা যায়, এটি দিয়ে ছবি আঁকার কাজও করা যেত। ফলে চিত্রশিল্পীদের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছিল ডিভাইসটি। কিন্তু তা সরাসরি অ্যাপেলের পণ্য ছিল না। ছিল সুমগ্রাফিক্স নামের একটি ফার্মেও তৈরি। অ্যাপেল তাদের সঙ্গে দোস্তি করে বাজারে এনেছিল ডিভাইজটি। সুমগ্রাফিক্স ফার্ম যা তৈরি করেছিল, সেটি ছিল মূলত ইন্টেলিজেন্ট ডিজিটাইজার। বলা চলে বিটপ্যাড। যা ছিল মূলত পেন কম্পিউটিং ট্যাবলেট। তবে শুধুমাত্র হোম কম্পিউটার গ্রাফিক্স ট্যাবলেটের সূচনার কথা বলতে গেলে শুরু করতে হবে কোয়ালাপ্যাড দিয়ে। সেটি ১৯৮৩ সালে বাজারে আসে।

কোয়ালাপ্যাড চিত্রাঙ্কনের জন্য এটি ছিল তৎকালীন বাজারে খুবই জনপ্রিয়। কোয়ালাপ্যাডের বাজার যখন রমরমা। তখনই বিস্ময়করভাবে বাজারে উপস্থিত হয় ওয়াকম। ১৯৮৪ সালে। যা এখন পর্যন্ত ডিজিটাল আর্টিস্টদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। এমনকি অনেকে গ্রাফিক্স ট্যাবলেট ডিভাইসটিকে ওয়াকম নামেই চেনে। ওয়াকম বলতেই তারা এখন গ্রাফিক্স ট্যাবলেট বোঝে। যদিও গ্রাফিক্স ট্যাবলেটের ৭৭ বছরের যাত্রায় একে একেক সময় একেক নামে ডাকা হয়েছে। যেমন, ড্রয়িং ট্যাবলেট, ডিজিটাল আর্ট ডিভাইজ, ডিজিটাল ড্রয়িং ডিভাইজ, ড্রয়িং প্যাড, গ্রাফিক্স ড্রয়িং ট্যাবলেট, পেন ট্যাবলেট, পেন ডিসপ্লে, ড্রয়িং ট্যাবলেট উইথ স্ক্রিন, ওয়াকম বোর্ড ইত্যাদি।

ওয়াকমই সর্বপ্রথম কর্ডলেস স্টাইলাস নিয়ে আসে। যা ডিজাইন ও গ্রাফিক্সকে আরেকধাপ আরামদায়ক করে। ফলে খুব সহজেই তা ক্রেতাসমাদৃত হয়। শুরুতে WT-460 মডেলটি দিয়ে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল জাপানি এই কোম্পানিটি। ওয়াকমের সূচনালগ্নেই কম্পিউটার এডেড ডিজাইনের উত্থান ঘটেছিল। যা প্রতিষ্ঠানটির জন্য সোনায় সোহাগা হয়েছিল। ওয়াকমের বাজারসফলতার জন্য এটিকে একটি বড় কারণ হিসেবে মনে করেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা।

ওয়াল্ট ডিজনির সঙ্গে যুক্ত হওয়াটাও ওয়াকমকে অগ্রগতি এনে দিয়েছিল। ওয়াকম ব্যবহারে অ্যানিমেশন জগতে একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। ফলে ওয়াকমের ভাগ্যের চাকাও সামনে এগোয়। এমনকি হলিউডের অনেক ফিল্ম প্রযোজনা সংস্থা ওয়াকমের এই পণ্যটি গ্রহণ করতে শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির গ্রাফিক্স ট্যাবলেট এতটাই সুপরিচিত হয়ে ওঠে যে ১৯৯৬ সালে বিল ক্লিনটন টেলিযোগাযোগ আইনে যেই সাক্ষর করেছিলেন, সেটি তিনি করেছিলেন ওয়াকমের স্টাইলার ও ট্যাবলেট ব্যবহার করে। ওয়াকমের সুবিধা সবচেয়ে বেশি ভোগ করে থাকেন ডিজিটাল আর্টিস্ট ও গ্রাফিক্স ডিজাইনাররা। এই কোম্পানির Bamboo সিরিজের ট্যাবলেটগুলো গ্রাহকদের চাহিদার তুঙ্গে। তবে এত কিছুর পরও ওয়াকম নিজেদেরকে বিশ্বের প্রথম স্টাইলাস-ভিত্তিক ট্যাবলেট দাবি করতে পারে না। সেই কৃতিত্ব যায় গ্রিডপ্যাডের ওপর। যা ছিল পেন কম্পিউটিং সিস্টেম। এই ট্যাবলেটটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়েছিল।

   

সে যা-ই হোক, বর্তমানে টেকজায়ান্ট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে গলায় গলায় ভাব করে নিয়েছে ওয়াকম। স্মার্টফোন কিংবা ল্যাপটপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গেও প্রতিষ্ঠানটির বেশ দহরম-মহরম। বিশেষ করে সামস্যাং, উইকোম ও ক্রোমবুকের সঙ্গে। গ্রাফিক্স ট্যাবলেট সরবরাহকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেক্কা দিয়ে জনপ্রিয়তার দিক থেকে এগিয়ে আছে ওয়াকম। প্রতিষ্ঠানটির Bamboo সিরিজের ট্যাবগুলো মূলত হোম এবং অফিস ইউজারদের কথা মাথায় রেখেই তৈরি। দামেও সাশ্রয়ী। Bamboo সিরিজের মধ্যে The Connect, The Splash, The Capture ও The Create পেন ট্যাবলেটগুলোর দিকে ব্যবহারকারীদের বেশি ঝোঁক। প্রতিষ্ঠানটির প্রফেশনাল লাইন-আপে আছে Intuos সিরিজ। ডিজিটাল আর্টিস্ট ও গ্রাফিক্স ডিজাইনারদের কথা মাথায় রেখেই এটি বানানো।

 

ওয়াকম ব্র্যান্ডের Intuos ট্যাবলেটে টাচ রিং কনট্রোল, এক্সপ্রেস কী, অ্যাডভান্স পেন টিপ সেন্সরসহ আরও কিছু সুবিধা মেলে। Intuos ৫ ট্যাবলেটগুলো মাল্টি-টাচ সার্ফেস। এটি দিয়ে ব্যবহারকারীরা গেসচার ব্যবহার করে নেভিগেট করতে পারে সহজেই। ওয়াকমের টপ লাইন-আপে Cintiq এর কিছু মডেল আছে। যেগুলো দিয়ে টাচ-সেন্সেটিভ প্লাস্টিক ড্রয়িং সার্ফেসের পরিবর্তে সরাসরি এইচডি স্ক্রিনের উপর আঁকা সম্ভব। যদিও Cintiq মূলত গ্রাফিক্স ট্যাবলেট নয়। এটি একটি ইনটের‌্যাক্টিভ পেন ডিসপ্লে। ওয়াকম ব্র্যান্ডের গ্রাফিক্স ট্যাবলেট বাংলাদেশি বাজারে সহজলভ্য করেছে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান মাল্টিমিডিয়া কিংডম। নগরীর এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্লান কম্পিউটার সিটি সেন্টারের তৃতীয় তলায় মাল্টিমিডিয়া কিংডমের ব্র্যান্ডশপ ও প্রদর্শনী কেন্দ্র (দোকান নং-৩১৬-৩১৭) থেকে সরাসরি কিংবা অনলাইনে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট (www.multimediakingdom.com.bd) থেকে ওয়াকম ব্র্যান্ডের এই গ্রাফিক্স ট্যাবলেটগুলো নিয়মিত কিনছেন ক্রেতারা।

ছবিঃ ইন্টারনেট