আপনি কি ছবি আঁকতে পছন্দ করেন? কাগজ কলম হাতে পেলেই কিছু না কিছু এঁকে বসেন? আপনার আঁকা এই ছবিগুলো ডিজিটাল এই যুগে ভার্চুয়াল বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে চান? এই কাজটি সহজ করার ডিভাইস হলো গ্রাফিক্স ট্যাবলেট। যে ছবি কাগজে আঁকতেন তা এই ডিভাইসটির সাহায্যে ডিজিটাল রূপ দেয়া সম্ভব সহজেই। ল্যাপটপ-ডেস্কটপের সঙ্গে জুড়ে রঙ-তুলি ছাড়াই আঁকতে পারেন ডিজিটাল গ্রাফিক্স ট্যাবলেটের সাহায্যে। এছাড়াও ইলাস্ট্রেশন, ফটোরিটাচ কিংবা ডিজিটাল সিগনেচারের জন্যও গ্রাফিক্স ট্যাবলেট অনন্য।

প্রায় এক যুগ ধরে দেশের বাজারে গ্রাফিক্স ট্যাবলেট বিক্রি এবং স্বনামধন্য আর্টিস্টদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার অভিজ্ঞতার আলোকে আমি কিছু পরামর্শ দিতে পারি। ট্যাবলেট কেনার আগে যা দেখবেন-

১. একটিভ এরিয়া (অঙ্কন এলাকা): একটি গ্রাফিক্স ট্যাবলেট কেনার সময় অবশ্যই একটিভ এরিয়ার বিষয়ে সচেতন থাকা উচিৎ। কারণ আপনি কী কাজ করবেন সেটার ধরন অনুযায়ী আপনাকে গ্রাফিক্স ট্যাবলেট নির্বাচন করতে হবে। আপনি যদি ছোট পরিসরের কাজ করেন তাহলে ছোট একটিভ এরিয়ার গ্রাফিক্স ট্যাবলেট নিলেই হবে। তবে যদি আপনি বড় আঁকারের ছবি আঁকেন তাহলে বড় একটিভ এরিয়ার গ্রাফিক্স ট্যাবলেটই সুবিধাজনক।

২. ডিসপ্লে: গ্রাফিক্স ট্যাবলেট ডিসপ্লে (এলসিডি) ছাড়া নাকি ডিসপ্লেসহ নিবেন সেটাও একটা জরুরি বিষয়। আবার পেপার ভার্সনও রয়েছে। বিষয়টা একটু খোলাসা করা যাক। ডিসপ্লেসহ গ্রাফিক্স ট্যাবলেটগুলোতে আপনি পর্দায় ছবি দেখে আঁকতে পারবেন। কিন্তু ডিসপ্লে ছাড়াগুলোতে আপনাকে ছবি আঁকতে হবে কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপের পর্দার দিকে তাকিয়ে। আর পেপার ভার্সনে গ্রাফিক্স ট্যাবলেটের উপরে আর্ট পেপার বসিয়ে তাতে আঁকা যাবে। এক্ষেত্রেও আউটপুট দেখতে কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপের মনিটরে তাকাতে হবে। সাধারণত ডিসপ্লেসহ গ্রাফিক্স ট্যাবলেটে বিল্টইন মেমোরি থাকে, যা আপনাকে বাইরে আঁকাআঁকিতে অনেক বেশি সহায়ক হবে।

৩. পেন প্রেশার বা কলমের চাপ সংবেদনশীলতা: যারা ছবি আঁকায় ডিটেইলিং পছন্দ করেন তাদের জন্য এ বিষয়টি ভীষণ জরুরি। বিষয়টা খুব বেশি কঠিন না হলেও লিখে বোঝানোটা কঠিন। যারা রঙ-তুলিতে আঁকেন তারা নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবেন; তুলিকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে চাপ তুলি মোটা চিকন আঁচর সৃষ্টি করে। বিষয়টা ডিজিটাল মাধ্যমেও সম্ভব। এজন্য প্রেশার সেনসিটিভিটি যত বেশি থাকবে তত মসৃণ আঁকা সম্ভব।

৪. পেন ব্যাটারি ফ্রি কি না: গ্রাফিক্স ট্যাবলেটে কলম সদৃশ যে অংশটি দিয়ে আঁকা হয়ে অর্থাৎ ডিজিটাল তুলি হিসেবে যেটা ব্যবহার করা হয়; তাকে স্টাইলাস বা পেন বলা হয়। সাধারণ এগুলো দুধরনের হয়ে থাকে। ব্যাটারি ফ্রি এবং রিচার্জেবল। বিষয়টা খুব ছোট হলেও জরুরি। কারণ কাজ করার সময় পেনে চার্জ না থাকলে সেখানে একটি ক্যাবল লাগিয়ে কাজ করাটা অস্বস্তির কারণ হতে পারে। তাই আমার পরামর্শ থাকবে চেষ্টা করবেন ব্যাটারি ফ্রি স্টাইলাসযুক্ত গ্রাফিক্স ট্যাবলেট ব্যবহার করার। তবে যারা টুকটাক গ্রাফিক্সের কাজের জন্য ট্যাব ব্যবহার করেন তাদের জন্য এটা খুব বেশি সমস্যা করবে না।

৫. এক্সপ্রেস কি: সহজভাবে বললে এক্সপ্রেস কি হল শর্টকাট কমান্ডের কি। আঁকাআঁকির সময় যে কাজগুলো আপনি বেশি করে থাকেন যেমন কাট, কপি, পেস্ট, রিডো, আন্ডু এসবের জন্য বারবার মাউস দিয়ে কমান্ড দেয়া কিংবা মেনুয়ালি কাজ করা বিরক্তিকর। এজন্য একটি গ্রাফিক্স ট্যাবলেটে কয়টি এক্সপ্রেস কি আছে তাও জরুরি। গ্রাফিক্স ট্যাবলেটগুলোতে সাধারণত ৩ থেকে ৮টি এক্সপ্রেস কি থাকে। আপনার প্রয়োজন মতো সেগুলো কাস্টমাইজ করে নিতে পারেন। গ্রাফিক্স ট্যাব কেনার ক্ষেত্রে কয়টা এক্সপ্রেস কি আছে তা দেখে নিবেন।

৬. ফ্লিপড করা যায় কি না: সাধারণত গ্রাফিক্স ট্যাবলেডগুলো যারা ডান হাতে কাজ করেন তাদের জন্যই তৈরি করা হয়। তবে বিশেষ কিছু গ্রাফিক্স ট্যাবলেট আছে যা উভয় হাতেই কাজের জন্য ফ্লিপড করার অপশন থাকে। আপনি যদি বাম হাতে কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে থাকেন তাহলে গ্রাফিক্স ট্যাবলেট কেনার আগে সেটাও দেখা জরুরি।

৭. ওজন ও বহনযোগ্যতা: আমাদের দেশে সাধারণত পণ্য ভারী হলেই সেটা ভালো বিবেচনা করা হয়। তবে ইদানিং ফোন আসার পর এ ধারণার পরিবর্তন এসেছে। মোবাইল ফোন অনেকেই স্লিম এবং হালকা ওজনের পছন্দ করেন। গ্রাফিক্স ট্যাবলেটের ক্ষেত্রেও বিষয়টা তেমনই। গ্রাফিক্স ট্যাবলেট অনেকেই হাতে নিয়ে কাজ করেন তাদের জন্য এটা আরো বেশি জরুরি। আর আপনি যদি অফিস কিংবা আউটডোরে কাজ করে অভ্যস্ত হন তাহলে পোর্টেবিলিটি আরো জরুরি।

৮. প্যাকেজে কী কী থাকছে: কেনার আগে অবশ্যই দেখে নেবেন প্যাকেটটি খুললে আপনি কী কী পাবেন। অনেক গ্রাফিক্স ট্যাবলেটের সঙ্গে একাধিক নিব, হাত মোজা, আর্টবোর্ড প্রভৃতি আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দিয়ে দেয়া হয়। আবার অনেকগুলোর সঙ্গেই থাকে না। মনে রাখবেন, গ্রাফিক্স ট্যাবলেটের পেন বা স্টাইলাসের কোন ওয়ারেন্টি হয় না। আর আনুষঙ্গিক পণ্যের দামও বেশি। সেক্ষেত্রে এক্সট্রা নিব খুবই জরুরি।

৯. কী কী ওএস কিংবা সফটওয়্যার সমর্থন করে: সমসাময়িক গ্রাফিক্স ট্যাবলেটগুলোতে সাধারণত সব ধরনের অপারেটিং সিস্টেমেই (ওএস) সমর্থন করে। তবে অনেকগুলোতে এখনো সব ওএস সাপোর্ট করে না। আমাদের দেশে যেহেতু বেশির ভাগ মানুষ উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করে সেক্ষেত্রে সেটা খেয়াল করে নেবেন। আবার অনেকেই অ্যান্ড্রয়েডের ট্যাবের সঙ্গে ব্যবহারের জন্য কিনে থাকেন। সেক্ষেত্রে গ্রাফিক্স ট্যাবলেটটি অ্যান্ড্রয়েড সমর্থন করে কি না তা অবশ্যই আগে জেনে নিবেন। আর সফটওয়ারের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে অ্যাডবির সফটওয়ারগুলো সবচে বেশি ব্যবহার হয়। আবার অনেকেই মাংগা কিংবা বিভিন্ন ধরনের এনিমেশন সফটওয়্যার ব্যবহার করেন। সেক্ষেত্রে সেই বিশেষ সফটওয়্যারটি গ্রাফিক্স ট্যাবলেটে সমর্থন করে কি না তা জেনে নিবেন।

১০. ওয়ারেন্টি: আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় সাধারণত গ্রাফিক্স ট্যাবলেটে খুব বেশি ওয়ারেন্টিতে আসেনি। তবে তারপরও কত মাস বা বছরের ওয়ারেন্টি পাওয়া যাবে তা জেনে রাখতে পারেন। সাধারণ ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত ওয়ারেন্টি পাওয়া যায়।

১১. ঘনঘন সফটওয়্যার আপডেট: অনেক গ্রাফিক্স ট্যাবলেটেই ঘন ঘন সফটওয়্যার আপডেট না দিলে কাজ করে না। বিষয়টা অনেক সময় বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেটা আগে দেখে নেয়া যেতে পারে।

১২. দাম কত: সর্বোপরি যে বিষয়টা দেখবেন সেটা হল গ্রাফিক্স ট্যাবলেটটির দাম কত? দেশের বাজারে ৩/৪ হাজার থেকে শুরু করে আড়াই-তিন লাখ টাকার ডিভাইসও পাবেন। তবে আপনাকে ঠিক করতে হবে আপনি উপরের বিষয়গুলো চিন্তা করে কেমন দামের পণ্য কিনবেন। এক্ষেত্রে একটা বিষয় শেয়ার করতে পারি। রাস্তায় বাঁশি বিক্রেতার সুন্দর সুর শুনে বাঁশি কিনলেন। আপনিও কি তেমন সুরে বাজাতে পারবেন? বিষয়টা অধ্যাবসায়ের আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, খুব বেশি দামী গ্রাফিক্স ট্যাবলেট দিয়ে না শুরু করে প্রথমে নিচের দিক থেকে শুরু করা ভালো।

হাত একটু ফ্রি হলে তারপর উপরিউক্ত বিষয়গুলো খেয়াল করে আপনার প্রয়োজনীয় ডিভাইসটি কিনতে পারেন। এখনো যদি আপনি কনফিউশনের থাকেন আমার সঙ্গে যোযোগ করতে পারেন। যে কোন সময় চলে আসতে পারেন আমাদের শপে। ডিভাইস না কিনলেও আপনি সহযোগিতা পাবেন আশা করছি। ধন্যবাদ।