
বছর তিনেক আগে শিরোনামহীন ব্যান্ড থেকে বিদায় নেন ভোকাল তানযির তুহিন। ব্যান্ডসংগীত প্রেমিরা তা নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যম উত্তাল করে ফেলেছিল। বিষয়টিকে মেনে নিতে অনেকেরই কষ্ট হচ্ছিল। আবার স্বাভাবিকভাবেও নিয়েছিল কেউ কেউ। বাংলাদেশে ব্যান্ড ভেঙে যাওয়ার ঘটনা তো আর নতুন কিছু নয়। সেই ভাঙ্গনের গোড়া খুঁজতে গেলে ১৯৬৭ সাল থেকে কথা তোলা দরকার। তবে তারও আগে গড়ে ওঠা বাংলা ব্যান্ড ‘আইওলাইটস’ থাকতে পারে এই আলোচনায়।

স্বাধীনতাপূর্ব জন্ম নেয় প্রথম বাংলা ব্যান্ড আইওলাইটস। ভাঙনের কবলে পড়েছিল এটিও। দলত্যাগী হয় ড্রামার সাব্বির এবং গিটারিস্ট রফিক। সেটির সমসাময়িক আরেকটি ব্যান্ড ছিল ‘জিংলা শিল্পগোষ্ঠী’। এর আঁতুড়ঘর বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। এই দুটির কোনটি প্রথম বাংলা ব্যান্ড- তা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে ভেঙেছে দুটিই। জিংলা শিল্পগোষ্ঠীর ভোকাল ছিলেন ওমর খালেদ রুমী। তিনিই দলছেড়ে অন্য একটি ব্যান্ডে যোগ দেন। এরপর আবারো সেই চট্টগ্রামেই জন্মেছিল আরেকটি বাংলা ব্যান্ড। ১৯৬৭ সালে। নাম ছিল ‘ব্যান্ড লাইটনিংস’। দলটি গড়ে উঠেছিল ফরিদ রশীদ, নিওম্যান্ডেজ, নোয়েল ও শাকিল নামে কজন সংগীতমনস্ক ব্যক্তির প্রচেষ্টায়। দেশে ব্যান্ডপ্রেমি আরও কজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তারাও বসে থাকেননি। ব্যান্ড লাইটনিংসের সময়কালেই মাহমুদ, তোতা, চিত্রনায়ক জাফর ইকবাল ও ফারুক মিলে গড়ে তুলেছিলেন ‘র্যাম্বলিং স্টেনস’ নামে একটি ব্যান্ড। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এই দুটি ব্যান্ডই বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়রতা পেয়েছিল। কিন্তু দুবছর পার হতেই ভাঙনের শিকার হয় ‘র্যাম্বলিং স্টেনস’। দলের যেসব সদস্য আলাদা হয়ে গিয়েছিল তাদের কজন মিলে গড়ে তুলেছিলেন নতুন ব্যান্ড 'টাইম গো মোশন'।
এ তো গেল স্বাধীনতার আগের কথা। এবার আসা যাক স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশি ব্যান্ড ও সেগুলোর ভাঙনের বয়ানে। ১৯৭২ সাল থেকেই এ দেশে ব্যান্ড গঠিত হতে শুরু করে। সেগুলোর মধ্যে কিছু ব্যান্ড বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে এবং কয়েকটি আবার বিবর্তিত হয়ে এখন পর্যন্ত টিকে আছে। নামেও বদল ঘটেছে বহুবার। বিলোপ পাওয়া ব্যান্ডগুলোর মধ্যে আগলি ফেসেস, আন্ডার গ্রাউন্ড পিস লাভারস, স্পন্দন ও উচ্চারণ ব্যান্ডের নাম উল্লেখযোগ্য। এই দলগুলোর কোনো কার্যক্রম এখন আর নেই।
ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই এবং ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী থেকে ফকির আলমগীর যুক্ত হয়েছিলেন উচ্চারণ ব্যান্ডে। এর আগে তারা ছিলেন স্পন্দন ব্যান্ডে। তাদের সঙ্গে ছিলেন পপ সম্রাট আজম খান। পরবর্তীতে পিলু মমতাজও যুক্ত হন উচ্চারণ ব্যান্ডের সঙ্গে। ফলে ব্যান্ডটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। সেই সময় তাদেরকে বলা হতো পাঁচপীর। কিন্তু সেই পঞ্চশিল্পী মিলে বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি উচ্চারণকে।
স্বাধীনতার পরে তৈরি হওয়া আরেকটি সংগীত দল ‘সুরেলা’। ভাঙনের কবলে পড়ে এটিও টেকেনি। তবে সেটি বিবর্তিত হয়ে তৈরি হয় ‘সোলস’ ব্যান্ড। বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘয়ু প্রাপ্ত ব্যান্ড এটি। তবে এতেও চলেছে ভাঙনের লীলা। ১৯৮৫ সালে এই দল থেকে বেরিয়ে যান নকীব খান। তৈরি করেন ‘রেঁনেসা’। এই সোলসেরই লিড গিটারিস্ট ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। টানা দশ বছর এই ব্যান্ডে ছিলেন তিনি। এরপর বেরিয়ে গিয়ে নিজেই গড়েন ‘এলআরবি’ ব্যান্ড। সেসময় এই ব্যান্ডে আইয়ুব বাচ্চুসহ স্বপন, টুটুল ও রিয়াদও ছিলেন। একটি সময় রিয়াদ বিদায় নেন এলআরবি থেকে। নিজের সলো ক্যারিয়ার গড়তে এলআরবি ছাড়েন এসআই টুটুলও।

ব্যান্ড ফিডব্যাকের জন্ম ১৯৭০ সালে। ভোকাল ছিলেন মাকসুদ। ১৯৯৬ সালে ফিডব্যাক ছাড়েন তিনি। তৈরি করেন ঢাকা ব্যান্ড। বালার্ক ব্যান্ডেরও একই পরিণতি হয়েছিল। এটি তৈরি হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। আশির দশকে বালার্ক ছাড়েন হ্যাপী আখন্দ, ইমতিয়াক ও কামাল। তারা ল্যারীর প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ড মাইলসে যোগ দিয়েছিলেন। যেটির জন্ম ১৯৭৯ সালে। মতান্তরে ১৯৮১। কালপরিক্রমায় মাইলসে যুক্ত হন হামিদ ও শাফিন। কিন্তু ২০১০ সালে দল ছাড়েন শাফিন। জানা যায়, ব্যান্ডে গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় পৃথক হয়েছিলেন তিনি। আলাদা হয়ে ‘রিদম অব লাইফ’ নামে নতুন একটি ব্যান্ড করেন। তবে বেশিদিন বাইরে থাকেননি তিনি। বছর না গড়াতেই ফেরেন মাইলসে।
১৯৮৪ সালের জুন মাসের ৫ তারিখ। ব্যান্ড ‘ওয়ারফেইজ’এর সূচনা। প্রচুর ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে এখনও টিকে আছে ব্যান্ডটি। ফিলিংস ভেঙে অর্থহীন হয়ে যাওয়া ব্যান্ডের বেইজ গিটারিস্ট সুমনও এক সময় ছিলেন ওয়ারফেইজে। ফিলিংসের জন্ম হয়েছিল চট্টগ্রামে। ‘নগর বাউল’ ও ‘অর্থহীন’ দুটি ব্যান্ডই তৈরি হয়েছিল ফিলিংস ভেঙে। ভোকাল পান্থ কানাইয়ের শুরুটাও হয়েছিল সেই ব্যান্ড থেকেই। পরে তিনি বেরিয়ে যান এবং ‘তাণ্ডব’ নামের ব্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। শেষ তথ্য পাওয়া পর্যন্ত তিনি ‘অর্নব অ্যান্ড ফ্রেন্ডস-এর সঙ্গে ছিলেন। ‘অর্থহীন’ ব্যান্ডের সূচনা ১৯৯৯ সালে। সেই সময় রুমির একটি ব্যান্ড ছিল। নাম ছিল ‘দ্য ট্র্যাপ’। তিনি তা ছেড়ে বেজবাবা সুমনের সঙ্গে যোগ দেন। এর কয়েকমাস পর অর্থহীন ব্যান্ডের দুই সদস্য- যুবায়ের ও আদনান দলত্যাগ করেন। ২০০১ সালে চলে যান রুমিও। ব্যান্ডটির দলনেতা বেইজ গিটারিস্ট সুমন ১৯৯৩ সাল নাগাদ ফিলিংস ব্যান্ডে ছিলেন বলে জানা যায়।

‘আর্ক’ এর পথচলা ১৯৯০ সাল থেকে। ভোকাল ছিলেন হাসান। পরে তিনি বেরিয়ে ‘স্বাধীনতা’ নামের একটি ব্যান্ড তৈরি করেন।কিন্তু সেখানেও থিতু হননি ব্যতিক্রমী এই ভোকাল। আবারো তৈরি করেন নতুন ব্যান্ড। নাম দেন ‘জন্মভূমি’।১৯৯৯ সালে গঠিত হয় ব্যান্ড ‘ব্ল্যাক’। কিন্তু সদস্যদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় সেটিও ভেঙে যায়। ব্ল্যাকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জন, জাহান, টনি, তাহসান ও মিরাজ। সলো ক্যারিয়ারের প্রত্যাশায় এক সময় ব্ল্যাক ছাড়েন তাহসান। আরেকদিকে জন বেরিয়ে তৈরি ব্যান্ড ‘ইন্দালো’ ।চলতি শতাব্দীর গোড়ায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানা নিয়ে আবির্ভূত হয় ‘বাংলা’ ব্যান্ড।
আনুশেহ, বুনো ও অর্ণবের রকিং কম্বিনেশনে তৈরি হয় এটি। এরপর সেখান থেকে বেরিয়ে অণর্ব তৈরি করেন ‘প্রেয়ার হল’ নামে একটি ব্যান্ড। সেটি টেকেনি। ২০০২ সালে ‘চিরকুট’ ব্যান্ডের জন্ম। ভোকাল সুমি। কিন্তু এর থেকে বেরিয়ে গেছেন ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য পিন্টু ঘোষ। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যান্ডের নাম ‘দূরবীন’। প্রায় ১৫ বছর আগে গঠিত হয়েছিল এটি। কিন্তু এটিও পড়ে ভাঙনের কবলে। বেরিয়ে যান কাজী শুভ ও আরেফিন রুমি।
এই ছিল বাংলাদেশি ব্যান্ডগুলোর ভাঙনের গল্প। উল্লেখ করার বিষয় হচ্ছে, ভাঙনের ফিরিস্তিতে দেশি অনেক ব্যান্ডের নাম এলেও ‘আর্টসেল’-এর নাম আসেনি। এটি দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডগুলোর একটি। ব্যান্ডটির উদ্ভব ১৯৯৯ সালে। চার বন্ধুর প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছিল আর্টসেল। ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই ব্যান্ডের ভাঙন সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
1 মন্তব্য
Very interesting points you have remarked, thanks for posting. “Great is the art of beginning, but greater is the art of ending.” by Henry Wadsworth Longfellow.
মন্তব্য করুন