
মাইক্রোফোন না থাকলে কী হতো? অতীতের পাতা থেকে জানা যায়- মানুষ পাহাড়, টিলা কিংবা উঁচু কোনো স্থানে উঠে নিজ গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য বক্তব্য দিতেন। অর্থাৎ, মানুষের ভয়েজই সর্বপ্রথম মাইক্রোফোন। কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর আর কতদূরই বা পৌঁছুতো! বেশি মানুষের কানে পৌঁছানোর জন্য তৎকালীন মানুষদের কিছুটা উচ্চস্বরেই করেই কথা বলতে হতো। কিন্তু শব্দকে বহুগুণে বাড়িয়ে প্রেরণ করার চেষ্টা শুরু হয় ১৬০০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে। অর্থাৎ, মাইক্রোফনের চল শুরু হয়েছে বেশিদিন হয়নি।

সালটা ১৬৬৫। ইংলিশ পদার্থবিদ ও আবিষ্কারক রবার্ট হুকের মাথায় আসে এক পাগলাটে চিন্তা। শব্দকে দূরে পাঠাতে চাইলেন তিনি। আবিষ্কার করে ফেললেন তারযুক্ত একটি অ্যাকোয়েস্টিক যন্ত্র। যা দিয়ে শব্দকে দূরে পাঠানো যেত। যদিও সেটিকে ঘটা করে মাইক্রোফোন বলা চলে না। ওটাকে ‘টিন ক্যান টেলিফোন’ বলা যায়। তবে শুরুটা সেখান থেকেই। তা ছাড়া হুকের যন্ত্রটি কেবল অল্প দুরত্বে থাকা একজন মানুষের কাছে আরেকজনের মানুষের শব্দ প্রেরণ করতে পারত। তা শব্দকে বহুগুণে বাড়িয়ে অগণিত মানুষের কাছে পৌঁছোতে পারত না।

মাইক্রোফোন শব্দটির সঙ্গে মানুষ পরিচিত হয় ১৮২৭ সালে। স্যার চার্লস হুইটস্টোনের মাধ্যমে। তিনিও একজন ইংরেজ পদার্থবিদ। যদিও টেলিগ্রাফ আবিষ্কারে তার অবদানের জন্য তিনি বেশি সমাদৃত। তবে মাইক্রোফোনেও তার অবদান কম নয়। তিনিই প্রথম ‘তরঙ্গ মাধ্যম’ ব্যবহার করে শব্দকে দূরে পাঠানোর প্রকৌশল জনসম্মুখে এনেছিলেন। এই পদ্ধতিতে শব্দকে বেশি দূরত্বে পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। পাশাপাশি দুর্বল শব্দকে বৃদ্ধি করে দূরে পাঠাতেও সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। অর্থাৎ, মাইক্রোফনের যাত্রা শুরু হয় তার হাত ধরেই। মাত্র এক বছরের মাথায় মাইক্রোফনের এই মহাযাত্রার সঙ্গী হন এমিল বারলিনার। গ্রামোফনে চোঙা ও সমতল গোলাকার ডিস্ক সংযুক্তির অবদান এই কীর্তিমানেরই। মাইক্রোফোনে দারুণ উন্নতি আনেন এই বিজ্ঞানী। এর দুবছরের মাথায় ডেভিড এডওয়ার্ড মাইক্রোফোনে চমৎকার এক পরিবর্তন আনেন। আবিষ্কার করেন কার্বন মাইক্রোফোন। এটি তৎকালীন শব্দপ্রকৌশলে এক প্রকার বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছিল। বিংশ শতাব্দীর রেডিও ট্রান্সমিশনে এর বহুল ব্যবহার হতো। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক উন্নত সংস্করণের মাইক্রোফোন এসেছে বাজারে।
মাইক্রোফোনের শব্দকে বৃদ্ধি করতে কাজে লেগেছিল ভ্যাকিউম টিউব প্রযুক্তি। ১৯১৫ সালে এই ধরনের এমপ্লিফায়ার যোগ হয়। কার্বন মাইক্রোফোনের পর আরও এক ধরনের মাইক্রোফোন বাজারে বেশ সাড়া ফেলেছিল। ১৯১৬ সালে। সেটি ছিল কনডেসার মাইক্রোফোন। ক্যাপাসিটার মাইক্রোফোন নামেও এটি পরিচিত। কেউ কেউ বলেন ইলেকট্রোস্ট্যাটিক মাইক্রোফোন। টেলিফোনের শব্দের গুণগতমান উন্নত করতে গিয়ে মাইক্রোফোনের মান উন্নত করে ফেলেছিলেন বিজ্ঞানী ই.সি ওয়েন্ট। তার এই কনডেসার মাইক্রোফোনকে তৎকালীন মানুষ ‘নিউম্যানের বোতল’ বলে ডাকত। এর দুটি কারণ ছিল। জার্মান ‘জর্জ নিউম্যান অ্যান্ড কোম্পানি’ এই ধরনের মাইক্রোফোন ডিজাইন করেছিল। যা দেখতে ছিল বোতলের মতো।

১৯২০ সালে রেডিওর অনুষ্ঠান মালায় দারুণ রদবদল ঘটেছিল। বেশি বেশি সংবাদ ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচারের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। ফলে রেডিওতে মাইক্রোফোনের ব্যবহার বেশ বেড়েছিল। এই বিপুল চাহিদা পূরণের জন্য ‘আরসিএ কোম্পানি’ বাজারে আনে রিবন মাইক্রোফোন। শুধুমাত্র রেডিও সম্প্রচারের জন্য। রিবন মাইক্রোফোন আবিষ্কারের নেপথ্যে ছিলেন জার্মান পদার্থবিদ ওয়াল্টার হেন্স স্কটি এবং ড.এরউইন। এই মাইক্রোফোনটি ছিল অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি। তাতে ছিল শক্তিশালী চৌম্বক তরঙ্গ। এরপর আবিষ্কার হয় ডায়নামিক মাইক্রোফোন। ১৯৩১ সালে।
মাইক্রোফোনে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে ১৯৫৭ সালে। ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ার রেমন্ডের বদৌলতে বাজারে আসে বেতার মাইক্রোফোন। তারের ঝামেলা না থাকায় এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চাহিদাও বেড়ে যায়। টেলিভিশন, রেডিও, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও গ্রহণ করেছিল এই ধরনের মাইক্রোফোন। এরপর যুগে যুগে এই যন্ত্রটির আরও উন্নতি ঘটেছে। এসেছে ক্রিস্টাল ও ডায়নামিকের মতো মাইক্রোফোনগুলো। একেকটি মাইক্রফোন একেক কাজে ব্যবহার হয়। তাই এই যন্ত্রটির এত রকমফের।
মাইক্রোফোন দেখতে খুবই সরল মনে হলেও এটির ব্যবহার কিন্তু জটিল। সঠিক নিয়মে ব্যবহার করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল মেলে না। তা ছাড়া সব কাজের জন্য সব ধরনের মাইক্রোফোন নয়। যেমন, রেডিও কমিউনিকেশনের জন্য বহুল ব্যবহৃত হয় কার্বন মাইক্রোফোন। ২৫০ ওহম ইম্পিডেন্স হওয়ায় এই ক্ষেত্রের এর ব্যবহার বেশি। ক্রিস্টাল মাইক্রোফোনের ইম্পিডেন্স বেশ উঁচু। তাই এর ব্যবহার টেলিফোন বিভাগ, রেকর্ডিং ইন্সট্রুমেন্ট ও ব্রডকাষ্টিং ষ্টেশনে বেশি। আমরা পথেঘাটে বক্তৃতা, অনুষ্ঠান কিংবা হারানো বিজ্ঞপির বয়ানে যেসব মাইক্রোফোন দেখি সেগুলো মূলত ডায়নামিক কিংবা মুভিং কয়েল মাইক্রোফোন। একটি অনুষ্ঠানে শব্দ যেমন থাকে, তেমনি শব্দদূষণও থাকে। অপ্রয়োজনীয় শব্দ বাদ দিয়ে কেবল প্রয়োজনীয় শব্দ গ্রহণের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রটির নাম রিবন মাইক্রোফোন। একে অনেকে ভেলসিটি মাইক্রোফোনও বলে। এমপিথ্রি কিংবা এমপি ফোর অপারেটর, পুলিশ ওয়ালেট অপারেটর, আধুনিক ট্যাক্সি, মেরিন ও মোবাইল রেডিওতে ব্যবহার হয় ট্রানজিস্টার মাইক্রোফোন। এ ছাড়া প্রায় সব ধরনের টেপরেকর্ডারে ব্যবহার হয় কন্ডেসার মাইক্রোফোন।
বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই মাইক্রোফোন ব্যবহৃত হয়। এই যন্ত্রটি ছাড়া তো ওপেন এয়ার-কনসার্ট ভাবাই যায় না। তা ছাড়া, সংগীত পরিচলকদের জন্য এটি অপরিহার্য একটি যন্ত্র। এটি ছাড়া সভা-সেমিনার যেন অকল্পনীয়। আনন্দ, বিনোদন, ধর্ম কিংবা শিক্ষার প্রসার, সর্বত্রই এর বিচরণ। এমনকি যেই মোবাইল ফোন দিয়ে আমরা কথা বলছি, সেখানেও আছে বিশেষ মাইক্রোফোন। এখনও চলছে এই যন্ত্রের উন্নতি সাধনের কাজ। কে জানে ভবিষ্যতে এর রূপ কী হবে। অন্য কোনো যন্ত্র এসে কি এর জায়গা দখল করে নেবে। নাকি দিন দিন এটি আমাদের যাপিত জীবনের সঙ্গে আরও জড়িয়ে যাবে? তাই শুরুর বাক্য দিয়েই লেখাটি শেষ করা যাক; মাইক্রোফোন না থাকলে কী হতো?
ছবিঃ ইন্টারনেট
1 মন্তব্য
If you're looking to step up your betting game, check out . I started using this platform not long ago, and it really helped me make better betting choices with its expert picks, stats, and up-to-date info. If you're into betting, you should definitely give it a shot.
মন্তব্য করুন