
ক্যালিগ্রাফি। বাংলায় চারুলিপি। ‘চারু’ ও ‘লিপি’ এই দুই কলার মিশেলে তৈরি একটি শিল্প। বর্ণ বাক্য ও শব্দকে সুন্দর করে আঁকাই হচ্ছে চারুলিপি তথা ক্যালিগ্রাফি। এটি এমন একটি শিল্প যেখানে বিভিন্ন প্রতীককে হাতের মাধ্যমে রচনা করে দৃষ্টিনন্দিত করা হয়। প্রতীকগুলোকে যথাসম্ভব নিখুঁত ও সুষম সজ্জায় বিন্যস্ত করাই ক্যালিগ্রাফির প্রধান মুন্সিয়ানা। এই শিল্পে বর্ণ ও শব্দের অখণ্ডতা, সাদৃশ্য, ঐতিহ্য, ছন্দের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হয়।
যাপিতজীবনে সর্বত্রই এর প্রয়োগ চোখে পড়ে। পথে যেতে যেতে সাইনবোর্ডে গোটা গোটা করে লেখা কোনো দোকানের নাম, বিয়ের কার্ডে পেঁচিয়ে লেখা বর ও কনের নাম, প্রাতিষ্ঠানিক সনদ কিংবা ধর্মালয়ের গায়ে লেখা বাণী, সবই চারুলিপির উদাহরণ। আদিম না হলেও এটি একটি প্রাচীন কলা। কেননা, মানুষের লেখনির ইতিহাস খুব বেশিকালের পুরাতন নয়। পাঁচ হাজার বছর। মতান্তরে ছয় হাজার। চারুলিপির উৎপত্তি লেখনি আবিষ্কারের পরে। অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে এই কলা অর্বাচীন।

চারুলিপির উৎপত্তি সন্ধানে হায়ারোগ্লিফিক লিপির আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। এই লিপির আঁতুড়ঘর মিসর। ছয় হাজার বছর আগে। লেখাগুলো মূলত অনেকগুলো চিত্রের সমন্বয়। ছবিগুলোই অক্ষর। এইসব বর্ণকে নিখুঁত করার কসরত চলত বেশ। তাই হায়ারোগ্লিফিকই হতে পারে চারুলিপির সবচেয়ে প্রাচীন উদাহরণ। কিন্তু কালের বিবর্তনে লেখ্যরীতিতে ভীষণ পরিবর্তন আসে। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে উৎপত্তি হতে থাকে আলাদা আলাদা বর্ণ ও বর্ণমালা। সকল অঞ্চলের বর্ণমালাগুলো হায়ারোগ্লিফিকের মতো যত্নআত্তি পেয়ে বিকশিত হয়নি। ফলে একটা সময় চারু ও লিপির মধ্যকার প্রাচীন সমন্ধের বিচ্ছেদ ঘটে। তারপর যখনই যেখানে আবারো চারুর সঙ্গে লিপির সম্বন্ধ ঘটেছে, সেখানেই সেই শিল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ক্যালিগ্রাফি। রোম, গ্রিস, আরব, চীন, জাপান কিংবা ভারতবর্ষ- সর্বত্রই এই শিল্পের বিচরণ।

ক্যালিগ্রাফি শব্দটির উদ্ভব ঘটে গ্রিক ভাষা থেকে। kallos এবং graphein এই শব্দ দুটি মিলে Calligraphy শব্দটির উৎপত্তি। kallos অর্থ সুন্দর এবং graphein মানে লেখা। অ্যাসিরীয় কিংবা ব্যাবিলনীয় কিউনিফর্ম এবং এর পরবর্তী ফিনিশীয় বর্ণমালা সভ্যতার প্রবাহে পালে নতুন হাওয়া পায়। গ্রিক ও রোমানরা সেই বাতাসেই তরী ভাসায়। সেখানে চার্চের অধীনস্থ একটি শ্রেণি ছিল বাইবেল সংরক্ষণের দায়িত্বে। তাদের মাধ্যমেই পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ক্যালিগ্রাফি শিল্পের রূপ পায়।
এবার আসা যাক ক্যালিগ্রাফির উৎপত্তি বিষয়ক প্রচলিত ইতিহাসে। ধারণা করা হয়, চারুলিপির প্রচলন রোমান সভ্যতায় ঘটে। ইউরোপের বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপত্যে এর নজির মেলে। চৈনিক নিদর্শনেও ক্যালিগ্রাফির হদিস আছে। চীনের শ্যাং বংশের রাজারা বিভিন্ন বস্তুর উপর চারুলিপি অঙ্কন করত। ভূমধ্য সাগরের পশ্চিম তীরের বাসিন্দারা এ ধরনের বর্ণমালার অভিজ্ঞতা লাভ করে যীশুর জন্মের ১৫শ থেকে ১ হাজার বছর আগে।
ক্যালিগ্রাফি শিল্পের ব্যাপক উন্নতি সাধন করে মধ্যপ্রাচ্য। আরব পারস্য ও তুর্কীদের অবদান এ ক্ষেত্রে বিপুল। ত্রয়োদশ শতকে ইরানে এক ধরনের চারুলিপির আবির্ভাব ঘটে। নাম তা’লিক লিপি। এই লিপির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রতিটি শব্দ আগের শব্দ থেকে নিচে স্বরে আসে। অটোম্যান আমলে দিওয়ানী নামে এক ধরনের লিপি দেখা যেত। তা সুসজ্জিত হলেও পড়তে বেগ পোহাতে হতো। সিংহাসনে সুলতানের নাম লেখার জন্য লিপিসজ্জার পদ্ধতি ছিল। এটিকে বলা হতো তুঘরা।

ক্যালিগ্রাফির কাঁচামাল মূলত অক্ষর কিংবা গণিতের সংখ্যা ও চিহ্ন। তবে সেই বর্ণ বা সংখ্যা অর্থবোধক হতে হবে। এই নকশাকে হতে হয় সঠিক অনুপাতে সজ্জিত। শুধু বর্ণ বা সংখ্যাই নয়, যেই মাধ্যমে বর্ণ ও সংখ্যা আঁকা হবে সেটির আশেপাশের আবহের সঙ্গেও এর একটা সাদৃশ্য থাকা চাই। একজন চারুলিপিশিল্পী যে ধরনের বর্ণ ও শব্দ নিয়ে শিল্প সৃষ্টি করছেন, সেই বর্ণের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ে তার সম্যক ধারণা রাখা জরুরী। কেননা, ক্যালিগ্রাফিক লিপি সেই ভাষার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অনেক ক্ষেত্রে তুলে ধরে। পুরো নকশাটি হওয়া চাই ছন্দময়। বিক্ষিপ্ত ক্যালিগ্রাফি দৃষ্টিদূষণ ঘটাতে পারে। পুরো শিল্পকর্মটিতেই যেন একটি ছান্দিক আবহ থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। জীবনের সঙ্গে মিল রেখে এই ধরনের শিল্প সৃষ্টি করে শিল্পীরা।
ভারতবর্ষের ক্যালিগ্রাফির ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। এ ক্ষেত্রে সংস্কৃত পাণ্ডুলিপিকে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে অশোকের রাজত্বকালে ভারতবর্ষে প্রথম লেখা পাওয়া যায়। উনিশ ও বিশ শতকে এই অঞ্চলে ক্যালিগ্রাফি নতুন উদ্যম পায়। বর্তমানে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা ছাড়াও শিল্প হিসেবে ক্যালিগ্রাফির ভীষণ কদর। শিল্প হিসেবেও ক্যালিগ্রাফি স্থান পেয়ছে। জাপানে ক্যালিগ্রাফারকে উচ্চ বেতনে চাকরি দেওয়া হয়।

দিন দিন উন্নত হয়েছে ক্যালিগ্রাফির ধরন। হাতে করা চারুলিপি ঠাঁই নিয়েছে যান্ত্রিক কোনো ডিভাইসে। এখন সেটি টাইপোগ্রাফির একটি শাখা মাত্র। নকশাচিত্রশিল্পের অন্যতম একটি অংশ হচ্ছে টাইপোগ্রাফি। এটিও অক্ষর সাজানোর কলাকৌশল। তবে এর পরিধি বিস্তৃত। যেমন, টাইপ ডিজাইনিং। অক্ষরসজ্জা শিল্প এর আওতায়ই পড়ে। বর্তমানে টাইপোগ্রাফির জনপ্রিয় একটি শাখা হচ্ছে গ্রাফিটি। পশ্চিমে এর আঁতুড়ঘর। এই কলার কোনো নিয়ম বা মাধ্যম নেই। অক্ষরকে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছেতাই করে এই শিল্প সৃষ্টি করা যায়। পপ কালচারে এটি বেশ গুরুত্ববহন করে। সিনেমা, পণ্য বা নির্বাচনের জন্য পোস্টারে যে বিশেষ ফন্ট ব্যবহার করে লেখা হয়, সেটিও এক প্রকার টাইপোগ্রাফি। চলচ্চিত্রের আগে-পরে কলাকুশলীদের নাম উঠতে দেখা যায়। সেগুলোও টাইপোগ্রাফির অংশ। এই কলার আরেকটি উল্লেখযোগ্য শাখা হচ্ছে লোগো ডিজাইনিং। প্রতীক বানানোর এই শিল্পকে এখন অনেকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বর্তমানে বেড়েই চলেছে টাইপোগ্রাফির ব্যবহার। এটি ছাড়া ডিজিটাল মাধ্যমগুলো অচল প্রায়।
ছবিঃ ইন্টারনেট
1 মন্তব্য
I recently came across a sports betting site that I really enjoy. provides live data, expert tips, and options for live betting, making it easier to make informed bets. If you're looking to up your betting game, you should definitely give it a look.
মন্তব্য করুন